লেখক, মনদীপ ঘরাই:সেদিন অফিস থেকে ফিরছিলাম। প্রতিদিনই ফেরার পথে মনে মনে চাই, যেনো গাড়িটা সিগনালে না আটকায়। চাই ঠিকই, রোজই হয় তার উল্টোটা। সিগন্যালে গাড়ি আটকানোর মূল সমস্যাটা ভিক্ষুক।গাড়ির দু পাশে এসে অনবরত সাহায্য চাইতেই থাকে। কেউ আবার একটা নোংরা কাপড় দিয়ে গাড়িটা মোছা শুরু করে দেয় বখশিশের আশায়। ব্যাংকের চাকরি করে অনেক কষ্টে এই সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িটা কেনা। গাড়ির নূণ্যতম ক্ষতি হতে দিতে ইচ্ছে করে না। তাই, সিগন্যালে গাড়ি থামলে সতর্ক হয়ে চোখ খোলা রাখি।
আজ সিগন্যালটা একটু বেশিই সময় নিচ্ছে। পেছন থেকে দু একটা গাড়ি অনবরত হর্ন বাজিয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে কোন সময় যেনো চোখটা একটু লেগে এলো। কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হয়তো। হঠাৎ টের পেলাম গাড়ির জানালার কাঁচে কে যেনো দাঁড়িয়ে নক করছে।
বুঝলাম কোনো ভিক্ষুকই হবে, ওদিকে না তাকিয়ে হাতের ইশারায় সামনে যেতে বললাম। কাজ হলো না। জানালায় শব্দ হতেই লাগলো।
মেজাজ গরম করে কিছু একটা বলতে যাবো, এর মধ্যে তাকিয়ে দেখি জানালায় কোট-টাই পরা একজন মানুষ।
কৌতুহলে সাথে সাথে জানালার কাঁচ নামালাম। বললাম, বলুন প্লিজ।
লোকটা বললো,
আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন?
দামী পোশাকে থাকলেও তার আকুতিটা পথের ভিক্ষুকগুলোর মতোই শোনালো।
আমি বললাম, আপনাকে আবার কী সাহায্য করবো? টাকা?
লোকটা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
টাকা? অনেক বেশি আছে আমার। আমি খুব বিপদে পড়ে পথে নেমেছি। একটু সাহায্য করবেন?
আমি বললাম, কী সাহায্য চান বলুন তো!
লোকটা বললো, আমাকে একটা বিকেল দিতে পারেন!
আমি ভাবলাম পাগল নাকি লোকটা? বিকেল কিভাবে দেয়?
লোকটা একনাগাড়ে বলে গেলো,
ছেলেবেলায় আমার খুব যত্নের কিছু বিকেল ছিলো। ফল পাড়তাম, ক্রিকেট খেলতাম, নৌকা চালাতাম। পকেটে দু টাকা নিয়ে মনে করতাম বিশ্বটাকে কিনে ফেলতে পারবো। কারণ, আমাদের কাছে বিশ্বটাই ছিলো দু টাকার চটপটির বাটিটার সমান।
এরপর বড় হলাম। ব্যাবসায় নামলাম।
আস্তে আস্তে পকেট ভারী হলো, হৃদয় হয়ে গেলো শূণ্য।
যত্নের বিকেলগুলো হারিয়ে গেলো চিরতরে। বাসার মধ্যে খুঁজে দেখেছি। কারো কাছে একটা বিকেল নেই জানেন?
আমার বৃদ্ধ বাবার বিকেল ওষুধ আর ইনজেকশনের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। আমার স্ত্রীর বিকেল বাঁধা পড়েছে জিম আর কিটি পার্টির কাছে। সন্তানদের বিকেল ব্যাগে করে নিয়ে গেছে কোচিং এর স্যাররা।
তাই, রাস্তায় নামলাম। একেবারে সিগন্যালে। এখানে নাকি চাইলেই সাহায্য পাওয়া যায়! গাড়ির কাচ নামিয়ে কতজনকেই তো পাঁচশো-এক হাজার টাকা দিলাম এ জীবনে। এমন কেউ কি নেই যে আমাকে একটা বিকেল দিতে পারবে? একটা বিকেল দিন না….
কী বলবো বুঝতে না পেরে বললাম, দুঃখিত।আমার একটাই বিকেল। ভাংতি নেই।
সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। অদ্ভুত লোকটাকে পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটছে।
আমার মন বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। লোকটাকে মিথ্যে বললাম! আমারও তো বিকেল বিক্রি হয়ে গেছে কর্পোরেট মায়াজালে। বহু আগে। একটা খুচরো কিংবা ভাংতি বিকেলও আর নেই আমার। শূণ্য হৃদয় নিয়ে ফিরে যাচ্ছি গন্তব্যে।
লেকটার মতো আমারও কারো কাছে চাইতে ইচ্ছে করছে খুব,
একটা বিকেল দেবেন প্লিজ?