লেখক: মনদীপ ঘরাই :জলিল চাকরিটা ছেড়ে দেবে বলে ভাবছে। এই ভাবনাটা অবশ্য তার গত এক বছর ধরেই। অনেক চেষ্টার পরেও এর চেয়ে ভালো বেতনের চাকরি মিলছে না বলেই পড়ে আছে এখানে । প্রতিদিনই একবার করে ছাড়ার কধা ভাবে, তারপর ওসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে সে।
ড্রাইভারের চাকরিটায় কোন কারণে, কার বুদ্ধিতে এসেছে তা এখন ঠিকভাবে মনেও পড়ে না জলিলের। তবে, একবার ড্রাইভারের চাকরিতে ঢুকলে পেশা পরিবর্তন করাটা কঠিনই।
তার গাড়ির মালিক ব্যাংকার। লোকটা অনেক ভালো। পুরো পরিবারটাই জলিলের খুব পছন্দ। অপছন্দ একটা ব্যাপারই। ডিউটির টাইম। বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেয়ার জন্য সকাল সাতটায় আসতে হয়। সব কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত নয়টা-দশটা বেজে যায়।
এর সাথে আরও একটা সমস্যা অনুভব করে সে। এটা তার ব্যক্তিগত কিছু না, পেশাগত।
ড্রাইভারদের ব্যাপারে প্রচলিত একটা ধারণা আছে যে, এরা তেলচোর। হয়তো কথাটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্যিও, কিন্তু অন্য পেশার মানুষও তো চুরি কম করে না, কই তাদের তো অমুক চোর তমুক চোর বলে না। এজন্য শুধু চাকরি বদল না, পেশাটাও বদলে ফেলতে চায় জলিল।
আজ ছুটির দিন। জলিলের বস সায়হাম সাহেব পরিবারসহ আজ তার কোনো এক বন্ধুর বাসায় খেতে গেছেন। জলিল নিচে অপেক্ষা করছে।
নিচে গাড়িতে বসে জলিলের আজ মনে হতে থাকে, আর কোনো পেশায় কি এমন অপেক্ষা আছে?
এই যেমন গত তিন ঘন্টা ধরে গাড়ির মধ্যে বসেই অপেক্ষা করছে সে। এভাবে সময় কাটতে চায়?একটা স্মার্টফোন থাকলেও হয়তো সময় কেটে যেতো। তার বসের মতো তার নিজেরও তো চারজনের সংসার। সব খরচ এই অল্প বেতনে সামলানোটাও তো কঠিন। তাই আর স্মার্টফোন কেনার দুঃসাহসও করেনি সে।
অন্যদিন অপেক্ষা করতে এতটা অসহ্য লাগে না। আজ জলিলের মনটা বড় খারাপ।
ছুটির দিন বলে সকালটা বাসাতেই ছিলো। তার ছোট ছেলেটা টিভিতে একটা চিপসের অ্যাড দেখে খুব আশা নিয়ে বলেছে,
“আব্বু, আমারে এই চিপসটা আইনা দিবা।আইজই দিবা”
জলিল ছেলেটাকে বুকে টেনে আদর করেছে। মুখে কিছু বলেনি।
যে চিপসের অ্যাড টিভিতে বারবার দেখাচ্ছে, সেটা বিদেশি চিপস। দামটা সে বাসা থেকে বের হয়েই দোকানে জিজ্ঞেস করেছে। কৌটাতে করে বিক্রি হয়। একটা কৌটার দামই তিনশো টাকার উপরে। আজ মাসের ২৭ তারিখ। ৩০০ টাকা দিয়ে চিপস কেনার মতো বিলাস জলিলের মানায় না। তাই মনটা সারাদিনই বিষন্ন হয়ে আছে। ছেলেটার একটা সামান্য আবদারও পূরণ করতে পারছে না!
প্রায় চার ঘন্টা অপেক্ষার পর জলিলের বস নেমে আসে। সোজা বাসায় যায় পুরো পরিবার। গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার ঠিক আগে সায়হাম সাহেব বলেন,
“জলিল, একটা কাজ করে দাও তো। সামনের ওই সুপার শপ থেকে এক কৌটা চিপস কিনে দিয়ে যাও তো। এই চিপসটা নাকি নতুন এসেছে। সারাদিন টিভিতে অ্যাড দেখাচ্ছে। ছোট ছেলেটা খেতে চেয়েছে”
জলিলের কাছে নামটা নতুন নয়। তার ছোট ছেলেও তো একই চিপস চেয়েছে সকাল বেলা। সে কিনতে পারেনি।
এখন একই চিপস সে কিনবে অন্যের জন্য।
দোকান থেকে ধীর পায়ে ফিরছে জলিল। হাতে চিপসের প্যাকেট। অথচ…